১০ হাজার টাকা নিয়ে ব্যবসা শুরু করে, এখন রাশেদ চৌধুরির মাসিক ২০-৫০ লক্ষ টাকার পণ্য বিক্রি


নিজস্ব প্রতিবেদক: স্বপ্ন ছিলো উচ্চ শিক্ষার জন্য ইউরোপ যাবে। IELTS পরীক্ষা দেওয়ার পর অস্ট্রলিয়া যাওয়ার জন্য ব্যর্থ হোন, দুই বার ব্যর্থ হয়ে উদ্যোক্তা জীবনে পা রাখেন রাশেদ চৌধুরি। কোভিড-১৯ এর কারণে মানুষ যখন ঘর থেকে বের হতে পারে নি, ঠিক তখনই ২০২০ সালে ১লা সেপ্টম্বর রাশেদ চৌধুরি Jura Fish নামে একটি অনলাইন বিজনেস শুরু করেন। যেহেতু চাঁদপুর তার জন্ম স্থান এবং চাঁদপুরের ইলিশ দেশ ও দেশের বাহিরে খুবই জনপ্রিয় রয়েছে। আর এই ইলিশ নিয়েই শুরু করেন অনলাইন উদ্যোক্তা জীবন।
শুরুটা হয় করোনা কালীন মুহুর্তে। রাশেদ চৌধুরির বাবাকে চাঁদপুর সদর চোখের ডাক্তার দেখাতে গিয়ে বড় স্টেশন ইলিশঘাট থেকে ২ কেজি ওজনের ৩ পিছ ইলিশ কিনেন। বাড়িতে এসে ইলিশ ভাজা ও রান্না করলে স্বাদ ঘ্রাণ পান নি। খাবার খেতে বসে রাশেদের বাবা খুবই আপসোস করেন, তার বাবা বলেন ৮৮ বন্যার সময় প্রচুর ইলিশ খেয়েছেন, ইলিশের সেই স্বাদ আজকাল নেই। বাবার আফসোস তিনি সহ্য করতে পারেন নি। তিনি রাতেই ফেইসবুক, ইউটিউব ঘাটাঘাটি করেন। ইলিশে স্বাদ নেই কেনো তা নিয়ে অনেক ভিডিও দেখেন।
পরদিন সে চাঁদপুর চরভৈরব ইলিশ ঘাট চলে যান। সেখানে সে একজন জেলেকে দেখেন একটি জীবিত ইলিশ নিয়ে আসছে, যা দেখে সে বিশ্বাস করতে পারে নি। সে ঐ দিনই সর্বপ্রথম জীবিত ইলিশ দেখছে। এই ইলিশ গুলো জেলেরা ধরার সাথে সাথে ইলিশ ঘাটে নিয়ে আসেন এবং নিলামে বিক্রি করেন। রাশেদ ১ কেজি ওজনের ২ পিছ ইলিশ কিনেন। মাছ গুলো বাড়িতে এনে ভাজি করার সাথে সাথে পুরো বাড়ি ঘ্রাণে ভরপুর হয়ে যায়। খেয়েও প্রচুর স্বাদ পায়। রাশেদের বাবা বললেন এটাই আমাদের অরিজিনাল চাঁদপুরের ইলিশের ঘ্রাণ।
এরপর থেকেই রাশেদ চিন্তা করেন, বাজারে যেহেতু সামুদ্রিক ইলিশ কে চাঁদপুর ও নদীর ইলিশ বলে বিক্রি করে এবং মানুষ ইলিশের আসল স্বাদ পান নি, সে মানুষকে অরিজিনাল চাঁদপুরের ইলিশ পৌছে দিবে সরাসরি লোকাল ঘাট গুলো থেকে। মায়ের থেকে ১০ হাজার টাকা নিয়ে প্রথমত বিজনেস শুরু করেন। বর্তমানে তার মাসিক ২০-৫০ লক্ষ টাকার মাছ ও দেশীয় পণ্য বিক্রি হয়। রাশেদ চৌধুরি প্রতিদিন ৫২ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করে চাঁদপুরের রুপালি ইলিশ কালেক্ট করতেন। তার বাসা থেকে চাঁদপুর চরভৈরব যেতে ভালো গাড়ির সুব্যবস্থা না থাকায় প্রায় ৪ ঘন্টা সময় লাগতো। সেখান থেকে সারাদিন ইলিশ সংগ্রহ করে ঢাকা, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম সহ দেশের বহু জেলাতে হোম ডেলিভারি দিতেন।
কখনো কাস্টমারের বাসাতে যেতে যেতে রাত ৩ টা ৪ টা বেজে যেতো, কখনো একদিন পর গিয়ে পৌছাতো। শীতের কুয়াশায় মানুষ যখন সন্ধ্যা নামার সাথে সাথে ঘরবন্দী থাকতেন, তিনি পুরো রাত বাস ও সি এন জি তে কাটাতেন। বিজনেসের প্রথমের গল্প বলতে গিয়ে তিনি কান্নায় ভেঙে পড়েন। করোনাকালীন মুহুর্তে ও অনলাইন ইলিশ বিক্রির শুরু থেকে মাছের ক্ষেত্রে আলাদা হোমডেলিভারিম্যান পাওয়া যেত না। যেহেতু ককসেটে ইলিশ মাছ বরফ সহ প্যাকেজিন করে দেওয়া হতো, আইনি ভয়ে কোনো কুরিয়ার নিতে রাজি হতো না।
তিনি সারা দেশে বাস & সি এন জি তে করে হোম ডেলিভারি দেওয়া শুরু করেন। একটা সময় চাঁদপুর শহরে রীতিমতো দূর দুরন্তে হোম ডেলিভারির জন্য সুনাম অর্জন করা শুরু করেন। এর ফলে তার প্রতি মানুষের বিশ্বস্ততা গড়ে উঠতে থাকে। যদিও দেশের অনলাইন প্লাটফর্মে সুনাম অর্জন শুরু করেন, কিন্তু নিজ গ্রামের মানুষ, আত্মীয় স্বজন ও বন্ধুবান্ধব কিছু সংখ্যক প্রথমত হাসিঠাট্টা ও কটুক্তি কথা বলা শুরু করেন।
পড়াশোনা করে মাছ বিক্রি করছে ও নানা রকম মন্তব্য করতেন। এই সব কুটক্তি শুনে বহুদিন কান্না করেছেন রাশেদ চৌধুরি। ২০২০ সালে অনলাইনে মাছ বিক্রি সেক্টরটা খুবই কঠিন ছিলো। প্রথমত মাছ কেনা সেক্টর টা খুবই কঠিন ছিলো, মাছ বাজারে দা*লা*লে ভরপুর থাকে। সমুদ্রের ইলিশ নদীর বলে বিক্রি করে, ডেলিভারি সমস্যা, এত কিছু নতুন যে কারো জন্যই চ্যালেঞ্জকর ছিলো। এর মধ্যে অনেক প্রতারক চক্রের পেছন পরেন।
নতুন উদ্যোক্তা ক্যাশ কম থাকাতে, তিনি মায়ের থেকে ৩০ হাজার টাকা ও নিজের জমানো ২৬ হাজার টাকা সহ মোট ৫৬ হাজার টাকার একটি পার্সেল ঢাকা উত্তরা ক্যাশঅন ডেলিভারি দেন। নগদ টাকা না দিয়ে কাস্টমার একটি ব্যাংকের চেক হাতে তুলে দেন। রাশেদ চৌধুরি জানতেন না, চেক নিয়ে যে প্রতারণা করা যায়। তিনি সে টাকা আজও পান নি। এই ছাড়াও ঢাকা মাওতুয়েল ইয়াছিন মিজি নামে এক ভদ্রলোক মাছ রিসিভ করে ৫২ হাজার টাকা না দিয়ে পালিয়ে যান। আইনের আশ্রয় চেয়েও বার বার তিনি ব্যর্থ হোন। একজন তরুণ উদ্যোক্তা হয়ে ২ মাস আগে পরে দুই টি ধাক্কা তাকে থামিয়ে দেন। তিনি বিজনেস বন্ধ করে দেন।
প্রায় তিন মাস পর পরিবারের সাপোর্ট পেয়ে পুনঃরায় শুরু করেন। রাশেদ চৌধুরি বিজনেসের প্রথম দিকে বাবা-মা, সমাজ, বন্ধুবান্ধব সবার থেকেই বাঁধা পেয়েছেন, কেউ তাকে মাছ সেক্টরে দেখতে চায় নি। দিন দিন মাছের প্রতি তার গভীর আগ্রহ দেখে সবাই তাকে পজেটিভলি নেন ও বিভিন্ন ভাবে সহযোগীতা করতে থাকেন। তিনি বর্তমানে নদী-সমুদ্র হাওর ও দেশীয় সিজনালি সকল পণ্য নিয়ে বিজনেস করেন। ঢাকা কাজলা টোলপ্লাজা, যাত্রাবাড়ী নিজেস্ব অফিস রয়েছে, সেখানে প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন নদী অঞ্চল, হাওর ও সমুদ্র থেকে মাছ কালেক্ট করে এনে লাইভ ভিডিও করা হয়। ঢাকা, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম ও সিলেটে হোম ডেলিভারি দিয়ে থাকেন।
অন্যান্য জেলা গুলোতে কুরিয়ারের মাধ্যমে ক্যাশঅন ডেলিভারি দিয়ে থাকেন। বর্তমানে রাশেদ দেশের নদী, সমুদ্র ও হাওরের সকল ধরণের মাছ বিক্রি করেন। বর্তমানে রাশদ চৌধুরির বিভিন্ন মাছ ঘাট থেকে উপস্থিত থেকে সংগ্রহ করা, হোম ডেলিভারি দেওয়া, মাছ কেটে ধুয়ে দেওয়া, কাস্টমারদের সাথে কথা বলা ও অন্যান্য সেল বিষয়ে ১১ জন কাজ করতেছেন। রাশেদ চৌধুরির স্বপ্ন Jura Fish একদিন বাংলাদেশের অন্যতম বড় একটি ব্যান্ড হবে। তার প্রতিষ্ঠিত কোম্পানিতে হাজার হাজার যুবকের কর্মসংস্থান গড়ে উঠবে ইনশাআল্লাহ।
সংবাদের আলো বাংলাদেশ সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।