পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর কাজ করছেন বেরোবির ছয় উদ্ভাবনী শিক্ষার্থী
বেরোবি প্রতিনিধি: রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের (বেরোবি) ছয় জন উদ্যমী শিক্ষার্থী প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর নাগরিক অধিকার সুরক্ষা, ডিজিটাল অন্তর্ভুক্তি এবং নিরাপদ অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে গড়ে তুলেছেন ‘সিভিকশিল্ড’ নামে একটি নতুন উদ্ভাবনী প্ল্যাটফর্ম। নাগরিক শিক্ষা, ডিজিটাল নিরাপত্তা, আইনি সহায়তা এবং গল্পকথার সমন্বয়ে গড়ে ওঠা এই উদ্যোগের লক্ষ্য—সমাজের বঞ্চিত মানুষের কণ্ঠকে মূলধারায় আনা।
বিশ্ববিদ্যালয়জীবনেই তাঁরা লক্ষ্য করেন—নারী, ট্রান্সজেন্ডার, আদিবাসী, যৌনকর্মী, অনানুষ্ঠানিক খাতের শ্রমিক, পরিচ্ছন্নতাকর্মী কিংবা চা–বাগান শ্রমিকদের নাগরিক সচেতনতা ও ডিজিটাল নিরাপত্তা সম্পর্কে জানাশোনা খুব কম। সামাজিক বঞ্চনা, আইনি জটিলতা ও অনলাইন হয়রানি তাঁদের জীবনে বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায়। এসব সমস্যা থেকেই শুরু হয় ‘সিভিকশিল্ড’-এর ভাবনা।
সিভিকশিল্ড একটি ইন্টারঅ্যাক্টিভ ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম। এখানে গল্পকথা, নাগরিক শিক্ষা, কমিউনিটি সম্প্রচার এবং মানব–এআই সমন্বিত আইনি সহায়তা একসঙ্গে পাওয়া যায়। লক্ষ্য—প্রান্তিক মানুষের অভিজ্ঞতা তুলে ধরা, নিরাপদ অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা এবং তাদের নাগরিক ক্ষমতায়ন বৃদ্ধি।
উদ্যোগটি বাস্তবায়নে টেকনিক্যাল ও আর্থিক সহায়তা দিয়েছে এরাইজ ইয়ুথ ফাউন্ডেশন। তাদের সহায়তায় প্ল্যাটফর্মের ডিজিটাল অবকাঠামো, গবেষণা এবং নাগরিক শিক্ষা কার্যক্রম আরও শক্তিশালী হয়েছে।
প্রকল্পটিতে নানা দায়িত্বে কাজ করছেন আটজন উদ্যমী সদস্য। এদের মধ্যে আছেন সাইয়েদা তাসনিম, যিনি গবেষণা ও পর্যবেক্ষণ কার্যক্রম দেখভাল করছেন।
প্রশিক্ষণ ও যুব সম্পৃক্ততা নিয়ে কাজ করছেন নাজনিন মুসফিকা।
আইন ও অধিকার সংক্রান্ত দায়িত্বে দায়িত্ব পালন করছেন শুরমা আফরোজ মিলি।
অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন নিশ্চিত করতে অন্তর্ভুক্তি ও বৈচিত্র্য শাখায় কাজ করছেন আহসান হাবিব।
প্রকল্পের সকল যোগাযোগ ও প্রচারণা সামলাচ্ছেন বিশাখা, যিনি কনটেন্ট ও মিডিয়া দায়িত্বে আছেন।
দৈনন্দিন কার্যক্রম পরিচালনার জন্য অপারেশনস ও প্রশাসন বিভাগে দায়িত্ব পালন করছেন নাফিসা খুশি।
মাঠপর্যায়ে জনগোষ্ঠির সাথে সরাসরি সংযোগ রক্ষা ও সচেতনতা কার্যক্রম পরিচালনায় কমিউনিটি আউটরিচ দায়িত্বে আছেন মনিকা মারান্ডি।
এ ছাড়া সকল আর্থিক ব্যবস্থাপনা ও হিসাবরক্ষণ নিশ্চিত করছেন আফসানা ইসলাম আরনিকা, যিনি ফাইন্যান্স ও হিসাবরক্ষণ দেখছেন।
অপারেশনস ও প্রশাসন বিভাগের দায়িত্বে থাকা নাফিসা খুশি বলেন,
“সিভিকশিল্ড এমন একটি প্ল্যাটফর্ম, যা কণ্ঠস্বরকে সুরক্ষা দেয়, প্রান্তিক মানুষের অভিজ্ঞতাকে দৃশ্যমান করে। এখানে কাজ করতে গিয়ে দেখেছি—যখন কেউ নিজের কণ্ঠ ফিরে পায়, তখন সমাজও নতুন পথ খুঁজে নেয়।”
অন্যদিকে প্রশিক্ষণ ও যুব সম্পৃক্ততা বিভাগের নাজনিন মুসফিকা বলেন,
“যুবদের সম্পৃক্ততা ছাড়া টেকসই সামাজিক পরিবর্তন সম্ভব নয়। তাই তাদের নেতৃত্ব গঠন, ডিজিটাল শিক্ষা ও দক্ষতা উন্নয়নে আমরা বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছি।”
মিশন ও উদ্দেশ্য:
তাঁরা জানাচ্ছেন, সিভিকশিল্ডের মিশন হলো:
— প্রথম-পক্ষের বাস্তব গল্পকে শক্তিশালী করে সামাজিক পরিবর্তন আনা
— নাগরিক শিক্ষা, নেতৃত্ব ও কমিউনিটি সংযোগ বৃদ্ধি করা
— প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর অধিকার, নিরাপত্তা ও প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা
লক্ষ্য গোষ্ঠী:
এই উদ্যোগ মূলত কাজ করছে—
নারী ও তরুণ সমাজ, আদিবাসী জনগোষ্ঠী, ট্রান্সজেন্ডার ও তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ, যৌনকর্মী ও অনানুষ্ঠানিক খাতের শ্রমিক, চা-বাগান শ্রমিক, পরিচ্ছন্নতাকর্মী, স্থানীয় সাংবাদিক, নাগরিক কর্মী ও তরুণ নেতৃবৃন্দ
প্ল্যাটফর্ম কাঠামো:
১) গল্পকথা ও অন্তর্ভুক্তি মডিউল — প্রান্তিক মানুষের অভিজ্ঞতা ডকুমেন্টেশন
২) নাগরিক শিক্ষা কেন্দ্র — ভোট, সংবিধান, স্থানীয় প্রশাসন নিয়ে শিক্ষামূলক গেম, অডিও ও ভিডিও
৩) ফাইন্ড মাই এডভোকেট সিস্টেম — দ্রুত মানব ও এআই-সাহায্যসহ আইনি সহায়তা
কার্যক্রম ও কৌশল:
তিন অঞ্চলে (রাজশাহী, রংপুর, সিলেট) পাইলট প্রকল্প, মোবাইল-ফার্স্ট ওয়েব অ্যাপ উন্নয়ন, নাগরিক শিক্ষাবিদ, আইনজীবী ও লক্ষ্য জনগোষ্ঠীর সঙ্গে গবেষণা, জাতীয় সম্প্রসারণের জন্য নেটওয়ার্ক ও সহযোগিতা
প্রত্যাশিত ফলাফল:
১০ হাজার প্রান্তিক নাগরিকের ডিজিটাল ও নাগরিক সাক্ষরতা বৃদ্ধি, ৩ হাজার অধিকারের লঙ্ঘন চিহ্নিত করে আইনি সহায়তার সঙ্গে সংযুক্ত, সিভিকশিল্ড এফএম-এর মাধ্যমে ১০ লাখ মানুষের কাছে পৌঁছানো, ৫০০+ বাস্তব গল্প প্রকাশ, অনলাইন–অফলাইন মিলিত অংশগ্রহণের মাধ্যমে নাগরিক সম্পৃক্ততা বৃদ্ধি
দীর্ঘমেয়াদি ভিশন
সিভিকশিল্ডের লক্ষ্য—একটি বাংলাদেশ গড়ে তোলা যেখানে পরিচয়, লিঙ্গ, আর্থিক অবস্থা বা সামাজিক অবস্থান নির্বিশেষে প্রতিটি নাগরিক নিরাপদে, আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে এবং অর্থপূর্ণভাবে নাগরিক জীবনে অংশ নিতে পারে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষক মনে করেন, এই তরুণদের উদ্যোগ শুধু প্রযুক্তিনির্ভর একটি উদ্ভাবন নয়; বরং নতুন প্রজন্মের সামাজিক দায়বদ্ধতার শক্তিশালী উদাহরণ। তাঁদের মতে, ভবিষ্যতে জাতীয় পর্যায়ে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর অধিকার সুরক্ষায় ‘সিভিকশিল্ড’ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।


সংবাদের আলো বাংলাদেশ সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।