সোমবার, ২৪শে নভেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

শিরোনাম

পাঠ্যবইয়ে যুক্ত হচ্ছে আওয়ামী লীগের রাতের ভোটের অধ্যায়

সংবাদের আলো ডেস্ক: ২০১৮ খ্রিষ্টাব্দে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ক্ষমতার অপব্যবহার, দিনের ভোট রাতে করার প্রসঙ্গটি ২০২৬ শিক্ষাবর্ষে মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের পাঠ্যবইয়ে যুক্ত করা হচ্ছে।

জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) সূত্রে জানা গেছে, নবম-দশম শ্রেণির বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয় বইয়ের ‘স্বাধীন বাংলাদেশে গণঅভ্যুত্থান’ অধ্যায়ের একটি অংশে বলা হয়েছে, ২০১৪ খ্রিষ্টাব্দের ভোটারবিহীন নির্বাচন, ২০১৮ খ্রিষ্টাব্দের নির্বাচনের আগের রাতে ব্যালট বাক্স পূর্ণ করে জনগণের সঙ্গে প্রতারণা এবং ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দের ৭ জানুয়ারি প্রকৃত প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন প্রহসনের নির্বাচনের মাধ্যমে ২০৪১ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকার রোডম্যাপ প্রণয়ন করে আওয়ামী লীগ। জনগণ তাদের চিরস্থায়ীভাবে ক্ষমতায় থাকার এই নীলনকশা প্রত্যাখ্যান করে।

এদিকে অষ্টম শ্রেণির বাংলা সাহিত্য কণিকা বই থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ভাষণ বাদ দেওয়া হচ্ছে। প্রসঙ্গত, ২০২১ খ্রিষ্টাব্দের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ভাষণ পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করতে নির্দেশ দেয় হাইকোর্ট। পরে পুরো ভাষণযুক্ত হয় মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিকের বইয়ে।অষ্টম শ্রেণির সাহিত্য-কণিকা বইয়ে পুরো ভাষণ ও ভাষণসংশ্লিষ্ট তথ্য আছে ছয় পৃষ্ঠাজুড়ে।

পাঠ্যবইয়ে বলা হয়েছে, চব্বিশের গণঅভ্যুত্থান প্রমাণ করেছে নিপীড়ক শাসন যত শক্তিশালীই হোক, ন্যায্যতার দাবিতে জনমানুষের প্রতিরোধের কাছে তার পরাজয় অনিবার্য। এদিকে পাঠ্যপুস্তকে স্থান পেতে যাচ্ছে পতিত সরকারের নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির চিত্র। আগামী শিক্ষাবর্ষের পাঠ্যবইয়ে বলা হয়েছে, ‘শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদী শাসনের অর্থনৈতিক ফলাফল ছিল দীর্ঘ মেয়াদে ধ্বংসাত্মক। অভ্যুত্থান-পরবর্তী সরকার শেখ হাসিনা ও তার সহযোগীদের সম্পদ পাচার, দুর্নীতি এবং আর্থিক ক্ষেত্রে লুটপাটের প্রকৃত তথ্য জনগণের সামনে তুলে ধরার জন্য একটি কমিশন গঠন করে। তাদের রিপোর্টে দেখা যায়, গত ১৬ বছরে দেশ থেকে দুর্নীতির মাধ্যমে প্রতি বছর গড়ে ১৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের সমপরিমাণ সম্পদ বিভিন্নরূপে বিদেশে পাচার করা হয়েছে। এর দ্বারা প্রমাণিত হয়, একটি ক্ষুদ্র গোষ্ঠী রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে একটি ‘চোরতন্ত্র’ কায়েম করেছিল। তারা বাংলাদেশ ব্যাংকসহ সব আর্থিক প্রতিষ্ঠান দুর্বল ও ভঙ্গুর করে দেয়। এতে ব্যাংক, বিমা, ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানসহ অর্থনৈতিক কার্যক্রমে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ফলে জাতীয় জীবনের আর্থিক অগ্রগতি স্থায়ীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

এতে আরও বলা হয়, ১৯৭৫ খ্রিষ্টাব্দে শেখ মুজিব সরকার সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে একদলীয় শাসনব্যবস্থা বাকশাল প্রতিষ্ঠা করেন। এর মাধ্যমে গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রা থেমে যায়। রাজনৈতিক অগ্রগতির ধারাবাহিকতায় ১৯৭৯ খ্রিষ্টাব্দে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে দেশে বহুদলীয় গণতন্ত্র পুনরায় চালু হয়। এ সময় দেশের অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং গণতান্ত্রিক অগ্রগতিতে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়। ১৯৮১ খ্রিষ্টাব্দে নভেম্বর মাসে বিচারপতি আব্দুস সাত্তার দেশের রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন। তাকে অপসারণ করে ক্ষমতা দখল করেন সেনাপ্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল এইচ এম এরশাদ। এই এরশাদের সময় যে কয়টি নির্বাচন হয় তার সবগুলোই ছিল প্রশ্নবিদ্ধ। এছাড়া তিনি দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিহাদের কথা বলে ক্ষমতা গ্রহণ করেছিলেন, কিন্তু তার শাসনামলে দুর্নীতি বহুগুণ বৃদ্ধি পায়। তার বিরুদ্ধে জোরালো আন্দোলন গড়ে ওঠে। প্রায় ৯ বছরের আন্দোলনে নুর হোসেন, সেন, নাজির উদ্দিন জেহাদ, ডা. শামসুল আলম খান মিলনসহ অনেকে জীবনদান করেন। ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে ১৯৯০ খ্রিষ্টাব্দের ৬ ডিসেম্বর স্বৈরাচারী এরশাদ সরকারের পতন ঘটে। একটি অবাধ, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের প্রধান খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে গণতান্ত্রিক সরকার ক্ষমতা গ্রহণ করে ১৯৯১ খ্রিষ্টাব্দে ।

স্বাধীন বাংলাদেশে গণঅভ্যুত্থান’ অধ্যায়ে বলা হয়েছে, ২০০৮ খ্রিষ্টাব্দে নির্বাচনের মাধ্যমে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সরকার গঠন করে। ক্ষমতাসীন হয়ে শেখ হাসিনা সরকার স্থায়ীভাবে ক্ষমতায় থাকার আকাঙ্ক্ষা থেকে ক্রমাগত কর্তৃত্ববাদী হয়ে ওঠেন এবং বিরোধী রাজনৈতিক দল ও মতের মানুষের ওপর দমন-নিপীড়ন শুরু করেন। একইভাবে দুর্নীতির প্রসার, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো দুর্বল করার মাধ্যমে দলীয় কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার দল আওয়ামী লীগ বেপরোয়া হয়ে ওঠে। বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো, তরুণ শিক্ষার্থী এবং সাধারণ জনতা প্রতিবাদমুখর হয়ে ওঠে। এর মধ্যেই শেখ হাসিনা সরকার ক্ষমতা চিরস্থায়ী করার জন্য ২০১১ খ্রিষ্টাব্দে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনব্যবস্থা বাতিল করে। রাজনৈতিক দলগুলো ক্ষমতাসীন সরকারের অধীনে নির্বাচনে অংশ নিতে অস্বীকার করে। শুরু হয় নতুন সংকট।

জুলাই গণঅভ্যুত্থান বিষয়ে পাঠ্যবইয়ে বলা হয়েছে, সরকারি চাকরিতে কোটা প্রথাকে কেন্দ্র করে শিক্ষার্থীরা ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দের জুন মাস থেকে শান্তিপূর্ণ আন্দোলন গড়ে তোলে। এ আন্দোলন চলাকালে ১৫ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগ নির্মম হামলা চালালে আন্দোলন নতুন মাত্রা লাভকরে। ১৬ জুলাই রংপুরের রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দোলনকারী ছাত্র আবু সাঈদ এবং চট্টগ্রামে ওয়াসিম আকরাম, ফয়সাল শান্তসহ আরো কয়েকজন শিক্ষার্থী পুলিশের গুলিতে শহিদ হন। এ ঘটনায় সারা দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে এবং রাজপথে জন-আক্রোশের বিস্ফোরণ ঘটে। লাখ লাখ মানুষ রাস্তায় নেমে আসে। আন্দোলন দমাতে সরকার মাত্রাতিরিক্ত বল প্রয়োগ করতে থাকে। শত শত নিরস্ত্র ছাত্র-জনতা আন্দোলনে শাহাদাত বরণ করতে থাকে। সরকার আরো বেপরোয়া হয়ে ওঠে। শেখ হাসিনার সরকার যত বেশি শক্তি প্রয়োগ করতে থাকে, মানুষ তত বেশি আন্দোলনে সম্পৃক্ত হতে থাকে। এরই ধারাবাহিকতায় ৫ আগস্ট ফ্যাসিবাদী সরকারের পতন ঘটে এবং শেখ হাসিনাসহ ফ্যাসিস্ট কাঠামোর সহযোগীরা ভারতে পালিয়ে যায়। ইতিপূর্বে কোনো আন্দোলন সংগ্রামে এত বিপুলসংখ্যক নারীর অংশগ্রহণ ও নেতৃত্ব দেখা যায়নি। এর একটি স্থায়ী প্রভাব সমাজের ওপর পড়বে। গণআন্দোলনের আরেকটি ব্যতিক্রমী দিক হচ্ছে দেশব্যাপী দেওয়ালে দেওয়ালে বিপুল পরিমাণ গ্রাফিতি বা দেওয়ালচিত্র অঙ্কন। সেসব গ্রাফিতিতে বাংলাদেশের মানুষের চিরায়ত অধিকার চেতনা, জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে মানবিক ভাবনা, ইনসাফ, জাতীয় ঐক্য ও রাষ্ট্রীয় সংহতির চেতনা ফুটে ওঠে। এই গণআন্দোলনের ফলে জনগণের মধ্যে যে অধিকার সচেতনতা তৈরি হয়েছে তার ফলে জনগণ ভবিষ্যতের যে কোনো সরকারকে স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা এবং আইনের শাসন মেনে চলতে বাধ্য করবে। এভাবেই ন্যায্যতার দাবিতে আন্দোলনরত ছাত্র-জনতার বিজয়ের মাধ্যমে দুনিয়ার ইতিহাসে নজিরবিহীন এক দৃষ্টান্ত স্থাপিত হয়।

জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) পরিমার্জন কমিটির একজন সদস্য বলেন, নতুন শিক্ষাক্রম স্থগিত করে ২০২৫ শিক্ষাবর্ষ থেকে ২০১২ খ্রিষ্টাব্দের শিক্ষাক্রমের আলোকে পাঠ্যবই পরিমার্জন করে অন্তর্বর্তী সরকার। সেই ধারাবাহিকতায় ২০২৬ খ্রিষ্টাব্দের জন্যও ব্যাপক পরিবর্তন আনা হয়েছে। জানা গেছে, ২০২৬ শিক্ষাবর্ষে প্রত্যেক শ্রেণির পাঠ্যবইয়ে জুলাই গণঅভ্যুত্থান নিয়ে একটি করে অধ্যায় রাখা হয়েছে। মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে, বিশেষ করে বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয় এবং পৌরনীতি ও সুশাসন বইয়ে এ নিয়ে পূর্ণাঙ্গ অধ্যায় রয়েছে। যেখানে এ অভ্যুত্থানের প্রেক্ষাপট, ছাত্র-জনতার তুমুল আন্দোলন, শেখ হাসিনার সহিংস দমননীতির ইতিবৃত্ত বর্ণনা করা হয়েছে।

সংবাদের আলো বাংলাদেশ সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

সংশ্লিষ্ট সংবাদ

এই সপ্তাহের পাঠকপ্রিয়