সোমবার, ১৩ই অক্টোবর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

শিরোনাম

দারিদ্র্য আর সমাজের বাঁকা চোখ পেরিয়ে টিকে থাকার লড়াইয়ে নারী অটোভ্যান চালক সুলতানা

সঞ্জিত চক্রবর্তী, পাবনা প্রতিনিধি: পাবনা জেলার ফরিদপুর উপজেলার বনয়ারীনগর ইউনিয়নের সোনাহারা গ্রামের মোছা. সুলতানা খাতুন (২৫) যে নাম এখন অনুপ্রেরণার প্রতীক হয়ে উঠছে। সমাজের বাঁধাধরা ধ্যানধারণা, দারিদ্র্য আর জীবনের দুঃসহ বাস্তবতা সবকিছুকে পেছনে ফেলে নিজের জীবনটা নিজের মতো করে গড়ছেন তিনি। পেশায় তিনি একজন অটোভ্যান চালক। শুনে অনেকেই অবাক হন, কেউ কেউ হাসাহাসি করেন, তবুও হাল ছাড়েননি সুলতানা। দিনমজুর বাবা মুনতাজ আলী আর গৃহিণী মা বেলে খাতুনের বড় মেয়ে সুলতানার জীবনের গল্পটা যেন সংগ্রামের আরেক নাম।

তিন বছর আগে বিয়ে হয়েছিল একই উপজেলার বিলচাদু গ্রামের এক যুবকের সঙ্গে। কিন্তু সুখের আশায় গড়া সংসার টিকল না বেশিদিন। বিয়ের পরই জানতে পারেন, স্বামী মাদকাসক্ত। শুরু হয় নির্যাতন, অপমান আর অভাবের কালো অধ্যায়। একসময় সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে যায় ফিরে আসেন বাবার বাড়িতে। সেখান থেকেই শুরু হয় নতুন লড়াই, নতুন জীবনের গল্প। অন্যের ভ্যান ভাড়ায় চালিয়ে জীবনযুদ্ধ শুরু করেন সুলতানা। প্রতিদিনের কষ্টার্জিত টাকার বেশির ভাগই চলে যেত মালিকের হাতে। তবুও থেমে থাকেননি। অবশেষে বাবা-মা কিস্তিতে টাকা তুলে মেয়ের জন্য কিনে দেন একটি পুরোনো অটোভ্যান। সেই ভ্যানেই এখন প্রতিদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ছুটে বেড়ান সুলতানা, গ্রামের রাস্তায়, বাজারে, স্কুলের পথে। দিনে আয় হয় দুই থেকে তিনশ টাকা।

কখনো রোদে, কখনো বৃষ্টিতে, আবার কখনো সমাজের তির্যক দৃষ্টির নিচে তবুও মুখে এক চিলতে হাসি নিয়ে হ্যান্ডেল ধরেন তিনি। “শুরুতে সবাই হাসত,” বলেন সুলতানা খাতুন। “বলত, মেয়ে মানুষ ভ্যান চালাবে? কিন্তু এখন সেই রাস্তাতেই আমি নিজের ঘাম দিয়ে সংসার চালাই। কেউ সাহায্য না করলেও আমি থামব না। নিজের পায়ে দাঁড়াতে চাই।” মা বেলে খাতুন কণ্ঠরুদ্ধ হয়ে বলেন, “আমার মেয়ে ছোটবেলা থেকেই কষ্টের মধ্যে বড় হয়েছে। এখন ও ভ্যান চালায় বলে অনেকে হাসে, কিন্তু আমি গর্ব করি। মেয়েটা নিজের ঘাম দিয়ে সংসার চালাচ্ছে, এটা তো আমাদের গর্ব।” প্রতিবেশী আমেনা বেগমের চোখে সুলতানা এখন প্রেরণার প্রতীক— “আগে ভাবতাম মেয়ে হয়ে ভ্যান চালানো লজ্জার কাজ। এখন দেখি, সেই মেয়েটাই তো সবার উদাহরণ।

সকাল থেকে রাত পর্যন্ত পরিশ্রম করে, কিন্তু মুখে কোনো অভিযোগ নেই। ওর মতো মেয়েরাই সমাজের গর্ব।” সুশীল সমাজের নেতাদের মতে, সুলতানা শুধু একজন অটোভ্যান চালক নন—তিনি হয়ে উঠেছেন দৃঢ়তা, সাহস আর আত্মসম্মানের প্রতীক। তারা বলেন, “একজন নারী, যিনি সমাজের বাঁকা চোখ উপেক্ষা করে জীবনের হাল ধরেছেন—তার পাশে দাঁড়ানো এখন সময়ের দাবি। প্রশাসন ও বিত্তবানদের উচিত, সুলতানার মতো নারীদের জন্য স্থায়ী আয়ের ব্যবস্থা করা।” বনয়ারীনগর ১নং ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য জহুরুল ইসলাম বলেন, “সুলতানা খুব পরিশ্রমী ও সাহসী মেয়ে। তার পরিবার একেবারেই নিম্নবিত্ত। সমাজের বিত্তবানরা যদি তাকে সহযোগিতা করে, তাহলে সে আরও ভালোভাবে জীবনযুদ্ধটা লড়তে পারবে।” ফরিদপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মাহবুব হাসান বলেন, “সুলতানা যদি লিখিত আবেদন করে, উপজেলা প্রশাসন থেকে তাকে অবশ্যই সহযোগিতা করা হবে।” সমাজের বাঁকা চোখ, কটু কথা আর কষ্টের পাহাড় ডিঙিয়ে নিজের মতো করে জীবন সাজাচ্ছেন সুলতানা খাতুন। হয়তো তিনি জানেন না, তার এই সংগ্রামই একদিন অনেক নারীর জীবনে আলো হয়ে উঠবে।

সংবাদের আলো বাংলাদেশ সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

সংশ্লিষ্ট সংবাদ

এই সপ্তাহের পাঠকপ্রিয়