নাগরপুর রুটে ফিটনেসবিহীন ‘এসবি লিংক’ বন্ধ — অনিয়মে ভরা পরিবহন খাতের অন্দর কাহিনি


মনিরুল ইসলাম, নাগরপুর (টাঙ্গাইল) প্রতিনিধি: টাঙ্গাইলের নাগরপুর-পাকুটিয়া সড়ক একসময় ছিল ব্যস্ততম রুটগুলোর একটি। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে এই রুটে ছায়ার মতো ভর করেছিল অনিয়ম, দুর্নীতি ও ফিটনেসবিহীন যানবাহনের দৌরাত্ম্য। নাম ‘এসবি লিংক’ — তবে যাত্রীদের কাছে পরিচিত ছিল ‘ঝুঁকির প্রতীক’ নামে।
সম্প্রতি পাকুটিয়া এলাকায় ঘটে যাওয়া এক মর্মান্তিক দুর্ঘটনা যেন দীর্ঘদিনের অব্যবস্থার পর্দা সরিয়ে দিল। দুর্ঘটনায় প্রাণ হারায় এক স্কুলছাত্রী। এই ঘটনার পর ক্ষুব্ধ জনতা ফুঁসে ওঠে, বাসে ভাঙচুর চালায়, আর প্রশাসন অবশেষে নড়ে চড়ে বসে।
এরপর থেকেই ‘এসবি লিংক’ বাস বন্ধের দাবিতে এলাকায় নানা প্রচার-প্রচারণা দেখা যায়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও বিষয়টি ব্যাপক আলোচনার জন্ম দেয়।
প্রশাসনের খোঁজে উঠে এসেছে চমকে দেওয়ার মতো তথ্য। রুট পারমিটবিহীন, মেয়াদোত্তীর্ণ ফিটনেস সনদ, অদক্ষ চালক, অতিরিক্ত যাত্রী—সবই ছিল এই রুটের নিয়মিত চিত্র। এসবি লিংকসহ আরও কয়েকটি পরিবহন বছরের পর বছর কোনো বৈধ নথি ছাড়াই যাত্রী পরিবহন করে আসছিল।
স্থানীয়দের অভিযোগ, পরিবহন মালিকদের প্রভাবশালী সংযোগের কারণেই এতদিন এসব অনিয়মে প্রশাসন কঠোর হতে পারেনি।
নাম প্রকাশ করতে অনিচ্ছুক এক ব্যবসায়ী বলেন, “এই রুটে ভালো মানের গাড়ির খুব অভাব। এসবি লিংক বন্ধ হওয়ায় মানুষ কিছুটা হলেও নিরাপত্তা পাবে।”
এক পরিবহন শ্রমিক জানান, “আমরাও চাই নিয়ম মেনে গাড়ি চলুক। কিন্তু হঠাৎ বন্ধ করে দিলে শ্রমিকদের কষ্ট হয়। আগে প্রশিক্ষণ ও নতুন গাড়ি চালুর উদ্যোগ নিক প্রশাসন।”
একাধিক শিক্ষার্থীরা বলেন, “এই রুটে ভয় নিয়ে উঠতে হতো বাসে। এখন যদি নিয়ম ঠিকভাবে মানা হয়, তাহলে আমরাও নিশ্চিন্তে চলাচল করতে পারব।”
দুর্ঘটনার পর উপজেলা প্রশাসনের উদ্যোগে গত সোমবার এক বিশেষ সভা হয়। সভায় উপজেলা প্রশাসন, জনপ্রতিনিধি, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, শিক্ষক, ব্যবসায়ী ও পরিবহন সংশ্লিষ্টরা উপস্থিত ছিলেন। সিদ্ধান্ত হয় ফিটনেসবিহীন ও অনুমোদনবিহীন কোনো গাড়ি আর নাগরপুর-পাকুটিয়া রুটে চলতে পারবে না।
এরই মধ্যে গতকাল রাতে এসবি লিংক বাসস্ট্যান্ড ফাঁকা করে সব গাড়ি ঢাকায় নিয়ে গেছে। স্থানীয়রা জানান, বাস বন্ধের ঘোষণা আসার পরপরই রাতারাতি সব গাড়ি সরিয়ে নেওয়া হয়।
নাগরপুর উপজেলা বাস মালিক সমিতির সভাপতি মোঃ লোকমান হোসেন বলেন,“ইউএনও মহোদয়ের সাথে কথা হয়েছে এবং আমাদের কিছু শর্ত মেনে বাস পুনরায় চালানোর চেষ্টা করা হবে। তবে তিনি স্পষ্টভাবে জানিয়েছেন—‘এসবি লিংক’ নামে কোনো বাস আর চলবে না। বর্তমানে নাম পরিবর্তন করেও তাৎক্ষণিকভাবে বাস চালানো সম্ভব নয়। বিষয়টি আমি ইতোমধ্যে ঢাকা বাস মালিক সমিতিকে অবগত করেছি, তবে তাদের পক্ষ থেকে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত আসেনি। বাস বন্ধ হলে সাধারণ মানুষের যাতায়াতের কষ্ট হবে, এ কথাও প্রশাসনকে জানিয়েছি।”
সাবেক উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান ও বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক মোঃ রফিজ উদ্দিন বলেন,“এই গাড়িগুলো সম্পূর্ণ ফিটনেসবিহীন ও অনিয়মতান্ত্রিকভাবে চলত। আমি চাই, নতুন গাড়ি নির্বাচনের সময় ভালো মানের পরিবহন বাছাই করা হোক, যেন সাধারণ জনগণ আর কষ্ট না পায়।”
উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) আরাফাত মোহাম্মদ নোমান বলেন,“নাগরপুরবাসীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা আমাদের দায়িত্ব। আমরা কিছু বাধ্যতামূলক শর্ত দিয়েছি—প্রতিটি গাড়ির ফিটনেস নবায়ন, চালকের ডোপ টেস্ট, সিসিটিভি স্থাপন ও যাত্রী তালিকা সংরক্ষণ। কেউ নিয়ম ভাঙলে তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে এবং কোর্টের মাধ্যমে জরিমানা করা হবে।”
নাগরপুর রুটে ‘এসবি লিংক’ বন্ধ হওয়া প্রশাসনের সাহসী সিদ্ধান্ত। তবে এটাই শেষ নয় — এই ঘটনায় একদিকে প্রশাসনের দৃঢ়তা যেমন প্রশংসার দাবিদার, অন্যদিকে পরিবহন খাতে দীর্ঘদিনের অব্যবস্থারও প্রতিফলন ঘটেছে। এখন দেখার বিষয়—এই অভিযান কতটা স্থায়ী হয়, আর নাগরপুরবাসী আসলেই কবে নিরাপদ সড়কের নিশ্চয়তা পায়।
সংবাদের আলো বাংলাদেশ সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।