জুলাইয়ের আতঙ্ক ও জনতার প্রতিরোধ : সরকার কি হারাচ্ছে নিয়ন্ত্রণ – ইমরান হোসেন


যেখানে এক সময় জনগণ ভয়ে চুপ থাকতো, আজ সেখানে সরকারই মুখ লুকায়। একের পর এক রক্তাক্ত জুলাই আর ভেঙে পড়া রাষ্ট্রীয় শৃঙ্খলা নিয়ে জনমনে প্রশ্ন। এই কি সেই বাংলাদেশ, যার জন্য আন্দোলন হয়েছিল?
বাংলাদেশের রাজনৈতিক, সামাজিক ও মানবাধিকার পরিস্থিতি আজ এক অস্বস্তিকর বাঁকে এসে দাঁড়িয়েছে। একটি সময় ছিল যখন মানুষ ভয়ের ছায়ায় ঘরবন্দি ছিল; কথা বলতে ভয় পেত, সোশ্যাল মিডিয়ায় নিজের মত প্রকাশ করতেও দ্বিধা করত। অথচ আজ, সেই ভয় এখন সরকারি উচ্চপর্যায়ের আতঙ্কে পরিণত হয়েছে। একে একে গুরুত্বপূর্ণ পোস্ট মুছে ফেলছে প্রশাসন, মুখ লুকিয়ে রয়েছে সরকারের শীর্ষস্তরের অনেকেই।
দেশের বাস্তবতা যেন পাল্টে গেছে দ্রুত গতিতে।
জুলাই মাস: রক্ত ও শোকের প্রতীক।এখন আর জুলাই মাস ক্যালেন্ডারের একটি সাধারণ মাস নয়। বরং এটি রক্ত আর শোকের প্রতীকে পরিণত হয়েছে। ইতিহাস গড়েছে বারবার; গত বছর যেমন ছিল রক্তাক্ত, তেমনি এ বছরও জুলাই নিয়ে এসেছে বেদনাদায়ক স্মৃতি, প্রাণহানির খবর এবং চরম বিশৃঙ্খলা। বারবার মনে পড়ছে সেই দিনগুলো, যখন দেশের মানুষ নীরব চিৎকারে একত্রিত হয়েছিল শোষণ ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে।
তবে প্রশ্ন হচ্ছে, এইসব দিন দেখতে কি এত আন্দোলন হয়েছিল? কি এই July Revolution বা এই গণআন্দোলনের পরিণতি কি এইভাবেই হবে? ১৮ কোটি মানুষের দেশে কি এই ভবিষ্যৎ অপেক্ষা করছে?
জনগণের আকাঙ্ক্ষা ও বাস্তবতা বাংলাদেশের মানুষ একটি নিরাপদ, ন্যায়ভিত্তিক এবং দুর্নীতিমুক্ত সমাজ চেয়েছিল। স্বপ্ন ছিল এমন একটি রাষ্ট্রের, যেখানে জবাবদিহিতা থাকবে, উন্নয়ন হবে বাস্তব অর্থে, শুধু পোস্টার আর মিডিয়ার শিরোনামে নয়। যেখানে সাধারণ মানুষ থাকবে সম্মান ও মর্যাদায় জীবনযাপন করতে পারবে।
কিন্তু দুঃখজনক ব্যাপার হলো-আজ সেই স্বপ্ন অনেকটাই ভেঙে পড়েছে। জনগণের আস্থা কমে যাচ্ছে। সরকারের প্রতি অনাস্থা বাড়ছে। এমন একটা অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে যেখানে বিচারহীনতার সংস্কৃতি প্রবল, প্রশাসনের নিরবতা চোখে পড়ার মতো। অপরাধী কখনোই সঠিক বিচার পায় না, কিংবা ধরা পড়ে গেলেও কাঙ্ক্ষিত শাস্তি নিশ্চিত হয় না।
সরকারের কর্তৃপক্ষের কর্মকাণ্ড নিয়ে প্রশ্ন উঠছে সর্বত্র। আইন প্রয়োগে অস্পষ্টতা ও দ্বিচারিতা পরিলক্ষিত হচ্ছে। দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসন গড়ে তোলা হচ্ছে না, বরং ক্ষমতার অপব্যবহার ও স্বজনপ্রীতির চিত্র প্রতিদিন বাড়ছে।
এর ফলে, সামাজিক অস্থিরতা বাড়ছে, যেখানে সাধারণ মানুষ নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। জনতার স্পষ্ট দাবি বর্তমানে দেশের মানুষ স্পষ্ট ভাষায় দাবি করছে-“শান্তি ফিরিয়ে আনুন। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করুন। না পারলে জনগণের হাতে দেশ ছেড়ে দিন।
বাংলাদেশ কারো পারিবারিক সম্পত্তি নয়। এটি ১৮ কোটি মানুষের দেশ। তাই প্রত্যেক নাগরিকের অধিকার ও দায়িত্ব রয়েছে এদেশের প্রতি।
জনগণের দাবিগুলো স্পষ্ট:
• গণতন্ত্রের পূর্ণ বাস্তবায়ন
• প্রতিটি হত্যাকাণ্ডের নিরপেক্ষ বিচার
• দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসন
• স্বাধীন গণমাধ্যম
• শক্তিশালী প্রতিরক্ষা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা
এই দাবিগুলো পূরণ না হলে, দেশের ভবিষ্যৎ আরও অন্ধকারময় হবে। কারণ এখন আর মানুষ মঞ্চে সাজানো নাটক দেখতে চায় না।
তারা চায় সত্যিকারের স্বচ্ছতা, ন্যায্যতা আর মানবিক রাষ্ট্র পরিচালনা। সরকারের হারানো নিয়ন্ত্রণ বর্তমান সরকারের নিয়ন্ত্রণ কি হারিয়ে ফেলছে? এমন প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে সর্বত্র। কারণ, দেশের শৃঙ্খলা দিন দিন ভেঙে পড়ছে। রাস্তাঘাটে বেড়ে চলেছে অপরাধের হার। রাজনৈতিক হিংসা ও সংঘর্ষ নতুন মাত্রায় পৌঁছেছে। প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তা ও সরকারের হীনমন্যতা এই পরিস্থিতিকে আরো জটিল করে তুলেছে।
স্বরাষ্ট্রউপদেষ্টা থেকে শুরু করে পুলিশের উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তাদের মধ্যে একপ্রকার বিভ্রান্তি ও দুর্বলতা দেখা যাচ্ছে। তারা অপরাধ দমনের চেয়ে নিজেদের দূর্বলতা নিয়ে বেশি চিন্তিত হয়ে পড়েছে। ফলে, দেশের নিরাপত্তা ব্যবস্থা সংকটাপন্ন। প্রতিদিনই ঘটে যাচ্ছে চুরি, হত্যাকাণ্ড, ধর্ষণ এবং সাম্প্রদায়িক সহিংসতা। এসব ঘটনা সমাজের সাধারণ মানুষকে আতঙ্কিত করছে।
স্বাধীন গণমাধ্যম ও বাকস্বাধীনতার সংকট
গণমাধ্যম আর স্বাধীন বাকস্বাধীনতা নামে নানা ধরনের অপপ্রচার গুজব চলমান । সংবাদ মাধ্যমে চাপ সৃষ্টি করা, সাংবাদিকদের হেনস্থা, কিংবা বিভিন্ন স্থানে সমন্বয়ক বা বিভিন্ন স্থানীয় নেতাদের হস্তক্ষেপ ঘটছে।
যদিও গণমাধ্যমের দায়িত্ব সত্য প্রকাশ করা, কিন্তু বর্তমান অবস্থা গণমাধ্যমকেও দমিয়ে রেখেছে। ফলে, খবরের সত্যতা অনেক সময় চাপা পড়ে যায় বা বিকৃত হয়।
বাকস্বাধীনতা নষ্ট হলে, সত্য প্রকাশ পায় না। আর সত্য না থাকলে, সরকার ও জনগণের মধ্যে আস্থা তৈরি হয় না। সরকারকে সঠিক পথে পরিচালিত করার জন্য দরকার মুক্ত ও দায়িত্বশীল গণমাধ্যম। এছাড়া, বর্তমান সরকারের উচিৎ সকল ধরণের গুজব প্রতিরোধ করা।
দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির বেড়ে ওঠা দুর্নীতির কারণে দেশে সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ বেড়ে গেছে। যদিও আওয়ামীলীগ আমলের তুলনায় অনেকাংশে কমে গেছে। তারপরও, সরকারি অফিসগুলোতে নানা প্রকার নীতিমালা লঙ্ঘন হচ্ছে, যা সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করছে।
স্বজনপ্রীতি ও অনিয়মের কারণে সৎ কর্মকর্তারা সুযোগ পাচ্ছেন না কাজ করার। এতে প্রশাসনের কার্যক্ষমতা কমে গেছে। বিগত সরকারের অনেক কর্মকতা বহাল তবিয়দে এখনো রয়ে গেছে। এসব অপসারণ এই সরকারকেই করতে হবে। তা না হলে এদেশে গনতন্ত্র নষ্ট হবে।
এছাড়া অনেক ক্ষেত্রে দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির কারণে সাধারণ মানুষ ন্যায় বিচার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। আর এই অবস্থা দেশের বিকাশকে ধীরগতিতে নিয়ে যাচ্ছে।
সার্বভৌমত্বের হুমকি ও প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার দুর্বলতা
দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষায় সরকারের ভূমিকা শক্তিশালী হওয়া জরুরি। কিন্তু সাম্প্রতিক কালে সীমান্তে নানা ধরনের হানাহানি, অনুপ্রবেশ এবং নিরাপত্তা বিঘ্নিত করার ঘটনা বেড়েছে। প্রশাসন ও সেনাবাহিনী এসব প্রতিকূলতার সম্মুখীন হলেও যথাযথ ব্যবস্থা নিচ্ছে না বলে মনে হচ্ছে।
সরকারের অক্ষমতা ও দুর্বলতা দেশের নিরাপত্তাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। এর ফলশ্রুতিতে দেশের মানুষের মধ্যে অনাস্থা তৈরি হচ্ছে।যার প্রেক্ষিতে কিছু সাধারণ জণগন আগেই ভালো ছিলো বলা শুরু করেছে।
জনগণের প্রতিরোধ ও প্রতিক্রিয়া দেশের মানুষ এখন কোনো প্রকার অন্যায় দেখলেই মাঠে নেমে পড়ে আন্দোলন করা শুরু করে । প্রতিবাদের এই পথটা সুন্দর প্রতিটি অন্যায়ের জবাব হিসেবে জনতা গণজাগরণ শুরু করেছে।
সোশ্যাল মিডিয়ায় সরকার বিরোধী পোস্ট ও প্রতিবাদী কার্যক্রম বেড়েছে। নিরাপত্তার ভয় সত্ত্বেও মানুষ সড়কগুলোতে নেমে এসেছে। তারা চায় পরিবর্তন, তারা চায় ন্যায়বিচার। এই জনতার আন্দোলনই সরকারকে আরো বেশি আতঙ্কিত করছে। কারণ, জনগণ বুঝতে শুরু করেছে তাদের অধিকার এবং তাদের অবাধ মত প্রকাশের স্বাধীনতা নস্যাৎ করা হচ্ছে।
সর্বশেষ কথা
আমরা চাই- একটি গণতান্ত্রিক, ন্যায়পরায়ণ এবং মানবিক রাষ্ট্র, যেখানে মানুষের নিরাপত্তা ও মর্যাদা সর্বোচ্চ মূল্যে থাকবে। সরকারের দায়িত্ব এই দেশের ১৮ কোটি মানুষের কল্যাণ নিশ্চিত করা, আর সেই দায়িত্ব তারা অবিলম্বে পালন করুক। আর নয় লুকোচুরি। আর নয় প্রতারণা। দেশটি জনগণের—এটাই শেষ কথা। আর প্রতিটি অন্যায়ের জবাব হবে প্রতিবাদেই। এই প্রতিবেদন পাঠকদের কাছে পৌঁছাক, যেন তারা বুঝতে পারে বর্তমান অবস্থা কতটা সংকটাপন্ন এবং পরিবর্তনের জন্য জনগণের ঐক্য কতটা জরুরি।
লেখক পরিচিতি:
ইমরান হোসেন, প্রাক্তন শিক্ষার্থী সরকারি তিতুমীর কলেজ, ঢাকা !
সংবাদের আলো বাংলাদেশ সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।