
সংবাদের আলো ডেস্ক: গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় মৃত্যুদণ্ডের রায় ঘোষণা করেছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১, যে ট্রাইব্যুনালটি যুদ্ধাপরাধের বিচার পরিচালনার লক্ষ্যে দেড় দশক আগে তাঁর সরকারই গঠন করেছিল।
সোমবার (১৭ নভেম্বর) দুপুরে বিচারপতি গোলাম মর্তূজা মজুমদার নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের বেঞ্চ এই রায় ঘোষণা করেন। বেঞ্চের অন্য দুই সদস্য ছিলেন বিচারপতি মো. শফিউল আলম মাহমুদ ও বিচারপতি মোহিতুল হক এনাম চৌধুরী।
এর আগে গত বৃহস্পতিবার এ মামলার রায়ের জন্য আজ ১৭ নভেম্বর দিন ঠিক করেছিলেন ট্রাইব্যুনাল।
বাংলাদেশ স্বাধীনতার ৩৯ বছর পর যুদ্ধাপরাধের বিচারের জন্য ২০১০ সালের ২৫ মার্চ গঠিত হয় ট্রাইব্যুনালের আইনজীবী প্যানেল ও তদন্ত সংস্থা। ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর আওয়ামী লীগ নির্বাচনী ইশতেহার অনুযায়ী আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল পুনর্গঠন করে। ১৫ বছর পর একই ট্রাইব্যুনালে আওয়ামী লীগের সভানেত্রীর বিরুদ্ধে বিচার কার্যক্রম সম্পন্ন হলো এবং মৃত্যুদণ্ডের রায় ঘোষণা করা হলো।
ছাত্র-জনতার জোয়ারে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ক্ষমতা ছেড়ে পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নেন শেখ হাসিনা। একই পথে হাঁটেন এ মামলার ‘অন্যতম কমান্ডার’ সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। দীর্ঘ শাসনামলে গুম-খুন, দুর্নীতি, গণহত্যাসহ নানা অভিযোগে অভিযুক্ত ছিলেন তারা। তবে ভাগ্যের নির্মম খেলায় আটকে যান তাদেরই একজন সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন। নিজের হুকুমদাতাদের ছাড়াই গ্রেপ্তার হয়ে জেলে যেতে হয় তাকে। যদিও রাজসাক্ষী হওয়ার কারণে কিছুটা কপাল খোলার চেষ্টা করেন তিনি।
বর্তমানে প্রসিকিউশনে থাকা একাধিক আইনজীবী আগে যুদ্ধাপরাধ মামলায় আসামিপক্ষের হয়ে লড়েছেন। তাঁরা শেখ হাসিনার নিজের প্রতিষ্ঠিত ট্রাইব্যুনালে বিচারের মুখোমুখি হওয়াকে 'প্রকৃতির বিচার' বলে আখ্যায়িত করেছেন।
প্রসিকিউটর গাজী এমএইচ তামিম বলেন, 'এটাই প্রকৃতির বিচার- যে আইন ও ট্রাইব্যুনাল শেখ হাসিনা নিজ হাতে তৈরি করেছিলেন, সেই কাঠামোর মধ্যে থেকেই তাঁর মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার হলো। এটি ভবিষ্যতের জন্যও একটি শিক্ষা।'
ট্রাইব্যুনাল সূত্র জানায়, আইসিটি বিডি মামলা নম্বর ২/২০২৫। এ মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল ও সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনকে আসামি করা হয়। অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে ২০২৪ সালের ১৪ আগস্ট শুরু হয় তদন্ত। একই বছরের ১৬ অক্টোবর মিস কেস ফাইল হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ওই দিনই শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন ট্রাইব্যুনাল। আর বাকি দুজনের নামে জারি হয় এর পরদিন। এর মধ্যে চলতি বছরের ১৬ মার্চ গ্রেপ্তার হন চৌধুরী মামুন। এরপর ১২ মে চিফ প্রসিকিউটরের কার্যালয়ে এ মামলার প্রতিবেদন জমা দেয় ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা। এর পরিপ্রেক্ষিতে ১ জুন ফরমাল চার্জ (আনুষ্ঠানিক অভিযোগ) দাখিল করে প্রসিকিউশন।
ফরমাল চার্জের সঙ্গে ১৪ খণ্ডে প্রায় ১০ হাজার পৃষ্ঠার দালিলিক সাক্ষ্য জমা দেওয়া হয়। এর মধ্যে পত্র-পত্রিকা, দেশি ও আন্তর্জাতিক অনুসন্ধান প্রতিবেদন, শহীদ-আহতদের তালিকা সম্বলিত গেজেট, বই, স্মারকগ্রন্থ, ঘটনাস্থলভিত্তিক আন্দোলনে আহত-নিহতের তালিকা, গাল ও গ্রাফিতির বই, অভ্যুত্থানকালীন প্রকাশিত পত্রিকার প্রথম পাতা সম্বলিত বই, শহীদ ও আহতদের চিকিৎসা সনদ, পোস্টমর্টেম ও সুরতহাল প্রতিবেদন, অস্ত্র ও বুলেট ব্যবহারের হিসাব সম্বলিত জিডি ও প্রতিবেদন, হেলিকপ্টারের ফ্লাইট শিডিউল ইত্যাদি। ৯৩টি প্রদর্শনীর মাধ্যমে এসব দালিলিক সাক্ষ্য ট্রাইব্যুনালে উপস্থাপন করা হয়। ৩২টি বস্তু প্রদর্শনীর মাধ্যমে অসংখ্য বুলেট, পিলেট, রক্তমাখা কাপড়, ভিডিও ও অডিও সম্বলিত ডিভিডি, পেনড্রাইভ, বই ইত্যাদি ট্রাইব্যুনালে উপস্থাপন করা হয়। এছাড়া ৮৪ জন সাক্ষীর জবানবন্দি ট্রাইব্যুনালে জমা দেওয়া হয়। যার মধ্যে ৫৪ জন সাক্ষী হাজির হয়ে সাক্ষ্য দিয়েছেন।
শেখ হাসিনার মামলায় পাঁচটি অভিযোগ আনে প্রসিকিউশন। এর মধ্যে প্রথমটি হলো উসকানি। গত বছরের ১৪ জুলাই গণভবনে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে আন্দোলনরত ছাত্র-জনতাকে রাজাকার বলে সম্বোধন করেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ওই রাতেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তখনকার ভিসি মাকসুদ কামালের সঙ্গে ফোনে আন্দোলনকারীদের ওপর নির্যাতন-নিপীড়নের আদেশ দেন তিনি। ১৮ জুলাই ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের সাবেক মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপসের সঙ্গে ফোনে কথা বলেন সাবেক এই সরকারপ্রধান। ফোনে আন্দোলনরত ছাত্র-জনতার ওপর মারণাস্ত্র ব্যবহারের পাশাপাশি হেলিকপ্টারে গুলির নির্দেশ দেওয়া হয়। একইসঙ্গে ড্রোনের মাধ্যমে ছাত্র-জনতার অবস্থান নির্ণয়ের নির্দেশ দেন হাসিনা।
তার এমন প্রত্যক্ষ নির্দেশনার মাধ্যমে দেশজুড়ে প্রাণ হারিয়েছেন ১৪০০ ছাত্র-জনতা। আহত হয়েছেন কয়েক হাজার আন্দোলনকারী। তৃতীয় অভিযোগটি হলো রংপুর বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবু সাঈদ হত্যা। আর চতুর্থ-পঞ্চম অভিযোগটি যথাক্রমে চানখারপুলে ছয় হত্যা ও আশুলিয়ায় ছয়জনকে হত্যার পর লাশ পুড়িয়ে দেওয়া। এই পাঁচটি অভিযোগই সন্দেহাতিতভাবে প্রমাণ করতে পেরেছে বলে দাবি প্রসিকিউশনের। এর পরিপ্রেক্ষিতে আসামিদের সর্বোচ্চ সাজা চেয়ে সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে ভুক্তভোগী শহীদ-আহত পরিবারের কাছে হস্তান্তরের আবেদন করা হয় ট্রাইব্যুনালে।
সংবাদটি শেয়ার করুন।
Copyright © 2025 সংবাদের আলো. All rights reserved.