পঙ্কজ সরকার নয়ন, গাজীপুর প্রতিনিধি: “সহিত” শব্দের সাথে “য” প্রত্যয় যুক্ত হয়ে গঠিত হয়েছে সাহিত্য শব্দটি। এটি নিছক একটি শব্দ নয়; যেন মেলবন্ধনের মহাজগৎ, যেখানে মিলে যায় ব্যক্তি ও সমাজ, সংস্কৃতি ও চেতনা, অনুভব ও যুক্তির সম্মিলন। সাহিত্যের প্রকৃত সৌন্দর্য এই একত্রে থাকা বিরাট ও বিচিত্র সত্তাগুলোর মাঝে একটি সুরেলা সেতুবন্ধন গড়ে তোলায়। সাহিত্যের প্রতিটি স্তবক, প্রতিটি অনুচ্ছেদ যেন বিশ্বজগতের অগণিত বিষয়ের সঙ্গে এক আত্মিক সংলাপে আবদ্ধ। সাহিত্য এমন এক শিল্পরূপ, যেখানে নিজের কথা, অপরের কথা, এমনকি সমগ্র বিশ্বমানবতার অভিজ্ঞতা, সাহিত্যিকের অন্তর্গত মনোবীণায় অপূর্ব সুরে ঝংকার তোলে। আর এই সুরের মধ্য দিয়েই জন্ম নেয় সত্য, সৌন্দর্য এবং মানবিকতার অন্বেষণ। সাহিত্যিকের কলমে ধরা পড়ে জীবনের উন্মুক্ত পাঠ; সেখানে আনন্দ-বেদনা, সংঘাত-সমাধান, প্রেম-প্রতিবাদ সবই একসঙ্গে ধ্বনিত হয়।
এই সাহিত্যকে হৃদয়ে ধারন করেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সাহিত্য সংসদের আয়োজনে ১২ থেকে ১৪ মে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত হয়েছে তিন দিনব্যাপী “ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সাহিত্য উৎসব ২০২৫”। প্রতিদিন সকাল ১০টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত চলা উৎসবজুড়ে ছিল বইমেলা, উদ্যোক্তা মেলা, আলোচনা সভা, কর্মশালা, চলচ্চিত্র প্রদর্শনী ও সাংস্কৃতিক আয়োজন। উৎসবে অংশ নেন দেশের খ্যাতিমান সাহিত্যিক, গবেষক, অনুবাদক, নাট্যজন, চলচ্চিত্র নির্মাতারা। অনুষ্টানের শেষ দিন সন্ধ্যায় একটি বিশেষ আলোচনা সভা অনুষ্টিত হয়। আলোচনার বিষয় ছিল - ‘‘প্রগতিশীল ও সাম্যের সমাজ নির্মাণে সাহিত্যিকের দায়বদ্ধতা’। উক্ত অধিবেশনে প্রধান আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন প্রফেসর ড. জে আলী এবং সম্পূরক বক্তা হিসেবে ছিলেন খন্দকার শফিকুল হাসান উজ্জ্বল ও মো. সোলায়মান আহমেদ জীসান।
ড. জে আলীর আলোচনা উৎসবের সন্ধ্যাটিকে করে তুলেছিল স্মরণীয়। সাহিত্যের সকল প্রকার বিষয় নিয়ে তিনি আলোচনা করেন। প্রথম কবে, কোথায়, সাহিত্যের সূচনা হয় আর সেই আলোর ছটা কিভাবে দেশ থেকে মহাদেশে, কাল থেকে মহাকালে ছড়িয়ে পড়েছে সেটি সম্পর্কে অবগত করেছেন। তিনি কথা বলেছেন সাহিত্যের বিভিন্ন অজানা ইতিহাস নিয়ে, অতীতচারী হয়ে কথার যাদুতে দর্শকদের নিয়ে গিয়েছেন প্রাচীন সাহিত্যিকদের কাছে। তার আলোচনা বিশ্লেষণ করলে আমরা দেখতে পাই তিনি গভীর অনুসন্ধানের মাধ্যমে সাহিত্যের প্রয়োজনীয়তা ও সাহিত্যিকের দায়বদ্ধতার বিষয়টি উপস্থাপন করেছেন। সাহিত্য যখন শুধুই কাব্যের রোমান্টিক ঘোরে সীমাবদ্ধ থাকে না, বরং সমাজের আয়না হয়ে ওঠে—তখনই তার প্রকৃত প্রভাব স্পষ্ট হয়। ড। জে আলীর আলোচনায় এমন এক চিন্তার প্লাবনে ভেসে উঠেছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাহিত্য উৎসব।
শিক্ষাবিদ ও সাহিত্যবোদ্ধা ড. জে আলী এক হৃদয়ছোঁয়া বক্তব্যে বলেন, “প্রগতিশীল সমাজ বিনির্মাণে কবি ও সাহিত্যিকদের ভূমিকা অনস্বীকার্য।” প্রগতিশীলতা মানেই যে শুধু আধুনিকতার মোড়কে পুরোনোকে ছুঁড়ে ফেলা, তা নয়। বরং এটি এক বিবর্তনের ধারা, যেখানে মানবিকতা, ন্যায়বিচার, মুক্তচিন্তা এবং সমতা—এই সবকিছু মূর্ত হয়ে ওঠে। এ কাজে সাহিত্যিকের কলম যেন সমাজের বিবেক হয়ে কাজ করে।। ইতিহাস ঘাঁটলেই দেখা যায়, প্রতিটি জাগরণের পেছনে কবি-সাহিত্যিকদের ভূমিকা রয়েছে। নজরুল তাঁর বিদ্রোহে যেমন কাঁপিয়ে দিয়েছিলেন বৃটিশ শাসন, তেমনি জীবনানন্দ তাঁর নিঃশব্দ বেদনায় তুলে ধরেছেন বিপন্ন সময়ের সুর।
ড. জে আলী তাঁর বক্তৃতায় তুলে ধরেন- বর্তমান বিশ্বে যখন বিভক্তি, বিদ্বেষ, এবং ভ্রান্ত তথ্যের সয়লাব চলছে, তখন একজন কবি বা সাহিত্যিক হতে পারেন আলো হাতে অন্ধকারের সৈনিক। সমাজকে প্রশ্ন করতে শেখানো, মৌলিক ভাবনার অনুপ্রেরণা দেওয়া, এবং মূল্যবোধের পুনরুদ্ধার—এসব কিছুই সম্ভব সাহিত্যের শক্তি দিয়ে। তিনি বলেন, “শব্দের ভেতর দিয়ে সমাজকে ঘুম থেকে জাগানো সম্ভব, যদি সেই শব্দ আসে আত্মার অন্তঃস্থল থেকে।” উৎসবের তরুণ সাহিত্যপ্রেমীদের মধ্যেও এই বার্তাটি গভীরভাবে সঞ্চারিত হয়। সাহিত্যের পরিসর যে শুধুই সৃজন নয়, বরং দায়িত্বপূর্ণ এক সামাজিক চেতনার ধারক ও বাহক—এই উপলব্ধি তরুণ প্রজন্মের কাছে পৌঁছানো আজ সময়ের দাবি।
সাহিত্য মূলত বহুমাত্রিক। এটি কখনো কবিতায় আবেগের দোলায়, কখনো প্রবন্ধে যুক্তির দৃঢ়তায়, কখনো গল্প-উপন্যাসে চরিত্রের জীবনঘনিষ্ঠতায়, আবার কখনো নাটকে বাস্তবের প্রতিকৃতিতে সমাজকে অনুপুঙ্খভাবে ফুটিয়ে তোলে। ড. জে আলী তাঁর আলোচনায় বলেন, আজকের সময়ে যখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মতপ্রকাশ সহজ হয়েছে, তখনও সাহিত্যকে অবজ্ঞা করা চলে না। বরং এখন সাহিত্যের দায়িত্ব আরও বেড়েছে। কারণ, অগণিত শব্দের ভিড়ে সত্য, ন্যায় ও যুক্তির স্বর অনেক সময় মুছে যেতে বসে। তখন একজন কবি, একজন সাহিত্যিকই পারেন সেই শব্দজগতে শুদ্ধ চেতনার বাতিঘরে আলো জ্বালাতে। তিনি বলেন, “যখন রাষ্ট্র নীরব থাকে, সাহিত্য তখন কথা বলে। যখন সমাজে মৌলবাদ, অসহিষ্ণুতা ও ভণ্ডামি মাথা তোলে, তখন সাহিত্যের জাগরণেই আসে বিপ্লব।” এই কথাগুলো নিছক বক্তৃতার বাগাড়ম্বর নয়; এটি যুগ যুগ ধরে সাহিত্যের যে সক্রিয় উপস্থিতি আমরা ইতিহাসে দেখেছি, তারই বাস্তব প্রতিফলন। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ড. আলী আরও বলেন, আমাদের মুক্তিযুদ্ধ, ভাষা আন্দোলন কিংবা গণতান্ত্রিক সংগ্রাম—সর্বত্র সাহিত্য ছিল নিরবিচারে একজন সৈনিকের ভূমিকা পালনকারী। বিশ্বের প্রতিটি বিপ্লবের ভেতরই সাহিত্যিকদের অগ্রণী উপস্থিতি ছিল। রুশ বিপ্লবে গোর্কি, ফরাসি বিপ্লবে রুশো-ভলতেয়ার, বাঙালির মুক্তিযুদ্ধে জহির রায়হান, আল মাহমুদ, শামসুর রাহমান—তাঁদের লেখনীতে জাতির আত্মপরিচয় খুঁজে পায় সাহস, দৃঢ়তা, স্বপ্ন। মুক্তিযুদ্ধের সময় কবিতার লাইন রাইফেলের গুলির চেয়েও প্রেরণাদায়ক ছিল।
আজকের দুনিয়ায় নতুন প্রজন্ম যখন ভুগছে বিভ্রান্তি আর তথ্যজালের যন্ত্রণা নিয়ে, তখন সাহিত্যের প্রয়োজন আরও গভীরভাবে অনুভূত হচ্ছে। একটি কবিতা, একটি ছোটগল্প, একটি উপন্যাস পারে সেইসব তরুণকে নতুন করে ভাবতে শেখাতে। প্রগতিশীলতা মানেই পাশ্চাত্য অনুকরণ নয়। এটি মানে- মননশীলতা, মানবিকতা, এবং ন্যায়ের পক্ষে দাঁড়ানো। সাহিত্যের মাধ্যমে সেই চিন্তার বিকাশ সম্ভব। একজন সত্যিকারের সাহিত্যিক কেবল নিজের অনুভূতিই প্রকাশ করেন না; তিনি সমাজের সত্তাকে ধারণ করে তাকে প্রশ্ন করেন, তাকে জাগ্রত করেন, এবং প্রয়োজন হলে বিদ্রোহ করেন। ড. জে আলী বলেন, “সাহিত্য যদি নিরপেক্ষ হতে চায়, তবে সেটি হয় নীরস অথবা ভীতু। সাহিত্যের নিজস্ব পক্ষ থাকা উচিত—তা হলো মানবতা, সত্য ও প্রগতির পক্ষ।
সাহিত্যিক কেবল শিল্পী নন—তিনি সময়ের বিবেক, সমাজের নির্মাতা, মানুষের মুখপাত্র। একজন কবি যখন অন্যায়ের বিরুদ্ধে লেখেন, একজন গল্পকার যখন নিপীড়িতের কথা বলেন, তখন তারা কেবল ভাব প্রকাশ করছেন না—তারা এক এক জন স্থপতি, যারা সমাজ নির্মাণের জন্য প্রতিটি শব্দকে ইটের মতো ব্যবহার করছেন। ড. জে আলী বলেছেন, কবি-সাহিত্যিকের কলম হচ্ছে এক অদৃশ্য ছুরি—যা অবিচারের মূলে আঘাত করে, অথচ রক্ত ঝরে না, ঝরে আলো। এই আলোই সমাজকে এগিয়ে নিয়ে যায়। সাহিত্যের একটি স্তবক হতে পারে যুগান্তকারী চেতনার সূচনা। একটিমাত্র প্রবন্ধ উদিত করতে পারে মানুষের ঘুমন্ত বিবেক। সাহিত্য এভাবেই নীরবে, কিন্তু নিশ্চিন্তভাবে সমাজকে বদলে দেয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তিন দিনের “সাহিত্য উৎসব” তরুণ লেখক, পাঠক ও গবেষকদের মাঝে সাহিত্যচর্চার নতুন অনুপ্রেরণা জোগাবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন আয়োজকগণ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাহিত্য উৎসব যেমন আমাদের সাহিত্য-চর্চার অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে, তেমনি ড. জে আলীর বক্তব্য আমাদের নতুন করে মনে করিয়ে দিয়েছে- সাহিত্য কেবল শিল্প নয়, এটি সমাজের চালিকা শক্তি। একজন কবির কলম, একজন প্রাবন্ধিকের যুক্তি কিংবা একজন নাট্যকারের মঞ্চ- সব মিলিয়ে সাহিত্যই পারে সমাজকে আলোকিত করতে, চেতনাকে জাগাতে, এবং প্রতিকূল সময়েও পথ দেখাতে। প্রগতিশীল সমাজ গড়ে তুলতে হলে আমাদের সাহিত্যচর্চাকে হতে হবে সচেতন, দায়বদ্ধ এবং সৎ। কবি-সাহিত্যিকদের শুধু সাহিত্য সৃষ্টি নয়, সমাজ বিনির্মাণেও পালন করতে হবে অগ্রণী ভূমিকা। তেমনই বিভিন্ন প্রকাশনা সংস্থাগুলোও যেন সাহিত্যিকদের যথাযথ মর্যাদা দিয়ে সাহিত্য সৃষ্টির পথটুকু সুগম করে সেদিকে সোচ্চার হতে হবে। আজকের সাহিত্যিকদের প্রতি আহ্বান- তারা যেন শুধুই শব্দের কারিগর না হয়ে উঠেন, বরং সময়ের অন্ধকারে সত্য ও আলোর দিশারী হয়ে ওঠেন। তবেই সাহিত্যের প্রকৃত লক্ষ্য পূরণ হবে, আর সমাজও এগিয়ে যাবে এক প্রগতিশীল, মানবিক, এবং সজাগ ভবিষ্যতের পথে।
মহিম চক্রবর্তী।
বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ।
সাউথইস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ে
সংবাদটি শেয়ার করুন।
Copyright © 2025 সংবাদের আলো. All rights reserved.