নালিতাবাড়ী প্রতিনিধি: যতদূর চোখ যায় শুধু দুলছে পাকা সোনালী ধান। কাঁচি হাতে ধান কাটতে কাটতে কৃষক গাইছে গ্রামীণ গান। শেরপুরের নালিতাবাড়ী ও নকলা উপজেলার হাজার হাজার হেক্টর জমিতে চাষকৃত চলতি মৌসুমের বোরো ধানের ফলন হয়েছে বাম্পার। বাম্পার ফলন হলেও শেষ মুহূর্তে মাজরা পোকার আক্রমণে ধানের শীষ মরে যাচ্ছে। এমতাবস্থায় দুশ্চিন্তা আর ফলন কম হওয়ায় শঙ্কায় পড়েছেন স্থানীয় কৃষকেরা।
দুই উপজেলার ২১ টি ইউনিয়ন ও ২ টি পৌরসভার সব এলাকাতেই এবছর বোরো ধানের আশানুরূপ ফলন হয়েছে। তবে নালিতাবাড়ী উপজেলার ৭ টি ইউনিয়নে ফসলের মাঠে মাজরা পোকার আক্রমণ দেখা গেছে। মাজরা পোকার আক্রমণ কবলিত ইউনিয়নগুলো হলো পোড়াগাঁও, নন্নী, নয়াবিল, রামচন্দ্রকুড়া, কাকরকান্দি, নালিতাবাড়ী ও বাঘবের। কয়েকটি গ্রামে দেখা গেছে বাদামি কারেন্ট পোকার উপদ্রব। এই পোকা আক্রান্ত ফসল অল্প সময়ের মধ্যে বেশি নষ্ট হয়।
কৃষি অফিস সূত্রে জানা গেছে চলতি মৌসুমে নালিতাবাড়ী উপজেলায় ২৩ হাজার ১৩৩ হেক্টর জমিতে বোরো ধান চাষ করা হয়েছে। ১ লক্ষ ৫০ হাজার মেট্রিক টন ধান লক্ষমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। নকলা উপজেলায় ১২ হাজার ৪২৫ হেক্টর জমিতে বোরো ধান চাষ করা হয়েছে। উৎপাদিত ধান থেকে এই উপজেলায় ৫০৩ মেট্রিক টন চাল লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, শ্রমিক ও মেশিন দিয়ে ধান কাটছেন কৃষকেরা। আবহাওয়া ভালো থাকায় খুব সহজেই ধান কেটে বাড়িতে এনে মাড়াই-ঝাড়াইয়ের পর বিক্রি ও গোলাজাত করতে পারছেন তারা।
স্থানীয় কৃষকদের ভাষ্যমতে, চলতি মৌসুমে বোরো ধানের ফলন ভালো হয়েছে। তবে কিছু দিন আগের শিলাবৃষ্টিতে কয়েকটি এলাকায় ৪০ ভাগ ধান ঝড়ে লোকসান হয়েছে। আবার বর্তমানে বেশ কিছু এলাকায় মাজরা পোকার আক্রমণে ফলনের পরিমাণ কমে যাচ্ছে। পাহাড়ি এলাকাগুলোতে বন্যহাতির তান্ডবে নষ্ট হয়ে গেছে অনেক ধান। আধাপাকা ধানই কেউ কেউ কেটে ফেলেছেন। বনবিভাগ জানিয়েছে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের আবেদন সাপেক্ষে সরকারী সহায়তা প্রদান করা হবে।
স্থানীয় কৃষকেরা জানান, চলতি বোরো মৌসুমে চিকন ও মোটা জাতের দেশি বিদেশি বিভিন্ন ব্র্যান্ডের ধান তারা চাষ করছেন। একর প্রতি ৩-৫ মণ করে ফলন হচ্ছে। তবে খরচের তুলনায় ধানের বাজার মূল্য অনেক কম বলে অভিযোগ কৃষকদের। স্থানীয় বাজারে কাঁচা ধান মণপ্রতি বিক্রি হচ্ছে ৮০০-৯৩০ টাকা দরে। এখানেই শেষ নয় ধান বিক্রি করতে এসে নাটকীয় ধলতার নামে প্রতি মণে দুই কেজি করে ধান বেশি গুণতে হয় বলেও অভিযোগ তাদের।
নকলা উপজেলার উরফা ইউনিয়নের বেনীরগোপ গ্রামের কৃষক আলহাজ্ব হাবিবুর রহমান ও মুনছুর আলী মীর দৈনিক জবাবদিহিকে বলেন, ধানের ফলন মোটামুটি ভালোই হয়েছে। কিন্তু খরচের তুলনায় ধানের বাজার মূল্য অনেক কম। ধানের দামটা আরেকটু বৃদ্ধি পেলে ভালো হতো।
নালিতাবাড়ী উপজেলার বারোমারী আন্ধারুপাড়া এলাকার কিতাব আলী, হাবিল উদ্দিন, বাদল মিয়াসহ বেশ কয়েকজন কৃষক জানান, তারা তাদের বোরো ধানক্ষেতে প্রয়োজন মতো সার বিষ প্রয়োগের পরেও এখন মরা শীষ বের হচ্ছে। এতে ফলন কমের আশঙ্কা করছেন তারা। তারা আরো জানান, বিভিন্ন কোম্পানির মাজরা পোকার কীটনাশক একাধিক বার প্রয়োগ করেও কাঙ্ক্ষিত ফল পাননি। তাদের সন্দেহ হচ্ছে জমিতে প্রয়োগ করা কীটনাশকের মধ্যে ভেজাল রয়েছে। এবিষয়ে কর্তৃপক্ষের সুদৃষ্টি আকর্ষণ করেন এই কৃষকেরা।
তবে কৃষি অফিস বলছে এবছর দিনের বেলা গরম আর রাতের বেলা শীত এই আবহাওয়া কৃষির জন্য প্রতিকূল। এমন আবহাওয়া থাকলে পোকামাকড়ের উপদ্রব বেশি হয়।
নকলা উপজেলার কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ শাহরিয়ার মোরসালিন জানান, চলতি মৌসুমে বড় কোন দুর্যোগ না হলে এই উপজেলায় ২০০ কোটি টাকার বোরো ধান উৎপাদন হতে পারে।
নালিতাবাড়ী উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ আব্দুল ওয়াদুদ বলেন, এবছর বোরো ধানের ফলন ভালো হয়েছে। তবে মাজরা পোকার আক্রমণের কারণে কয়েকটি ইউনিয়নের ধানখেতে মরা শীষ বের হচ্ছে। এটি মূলত এমন হয়েছে। যদি মরা শীষ শতকরা ৫ ভাগের বেশি বের না হয় তাহলে ফলন কম হওয়ার আশঙ্কা নেই। এবছর নালিতাবাড়ী উপজেলা থেকে ১৬টি কোম্পানির একই গ্রুপের কীটনাশক ল্যাব টেস্টের জন্য ঢাকায় পাঠানো হয়েছে। যদি কোনো কোম্পানির কীটনাশকে ভেজালের প্রমাণ পাওয়া যায় তাহলে ওই কীটনাশক নিষিদ্ধ করা হবে এবং কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। সার্বিক বিষয়ে কৃষি বিভাগ নানাভাবে কৃষকদের পরামর্শ দিয়ে আসছে।
নালিতাবাড়ী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ফারজানা আক্তার ববি দৈনিক জবাবদিহিকে বলেন, এবছর বোরো ধানের ফলন ভালো হয়েছে। মাজরা পোকার আক্রমণ হওয়া এলাকাগুলোতে কৃষি বিভাগের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। এছাড়াও ধলতার নামে দুই কেজি ধান বেশি নেওয়ার বিষয়ে আমি অবগত নই। তবে অভিযোগ প্রাপ্তি সাপেক্ষে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে বলে জানান তিনি।
সংবাদটি শেয়ার করুন।
Copyright © 2025 সংবাদের আলো. All rights reserved.